বাংলা চলচ্চিত্রের প্লেব্যাক জুটি
উপমহাদেশীয় চলচ্চিত্রে সংগীতের বিস্তরণ সেই শুরু থেকেই।বিশেষ করে চলচ্চিত্রের দ্বারা দর্শককে ফ্যান্টাসীর জগতে নিয়ে যাওয়া এবং দীর্ঘতর সময় পর্যন্ত রংগীন পর্দায় থিতু করে রাখার প্রয়াসেই সংগীতের ব্যবহার হতে শুরু করে।পরবর্তীতে কন্ঠশিল্পীদের সুরের মূর্ছনায় প্লেব্যাক শাখাটি হয়ে ওঠে বানিজ্যিক অনুষঙ্গ,এবং সেই আবেদন আজো ফুরোয় নি।বাংলাদেশীয় চলচ্চিত্রেও সাধারণ দর্শকের চিত্তকে বিমোহিত করতে নির্মাতারা নানা সময়ে নায়ক-নায়িকার পাশাপাশি গায়ক-গায়িকার জুটি প্রথাও নিয়ে আসেন।এবং সেক্ষেত্রে নির্মাতারা সফল ও বটে।আজ এ দেশীয় চলচ্চিত্রে ডুয়েট গানে জুটি প্রথা নিয়ে আলোচনা করব।মূলত শুরুর দিকের প্ল্যাব্যাক শিল্পীগণ ছিলেন একক মহিমাতেই উজ্জ্বল।ফেরদৌসী রহমান,মাহমুদুন্নবী,বশির আহমেদ,শাহনাজ রহমতুল্লাহ,খন্দকার ফারুক আহমেদ,মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী প্রমুখ শিল্পীগণ জুটি প্রথায় রাস্তা কাটেন নি।সাবিনা ইয়াসমিন ও একক গানেই বেশি সমাদৃত ছিলেন। তবে সৈয়দ আবদুল হাদীর আগমনের পর এই ধারার বিস্তার পায়।বিশেষ করে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে সাবিনা ইয়াসমিনের সাথে তার রসায়ন শ্রোতা বেশ ভালভাবেই নেয়।রুনা লায়লা এসে এই ধারাকে করেন আরো সমৃদ্ধ।আর আশির দশকে এন্ড্রু কিশোরের আগমনে শুরু হয়ে যায় ডুয়েটে জুটিপ্রথার স্বর্ণযুগ,কনকচাঁপা এসে এই প্লেব্যাক জুটিকে আরো বিকশিত করেন। সেই থেকে আজো চলছে।তবে বর্তমানে দূরদর্শী সঙ্গীতজ্ঞদের শূণ্যতায় প্লেব্যাক শাখা অনেকটাই স্থিমিত।
বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম সেরা দশ প্লেব্যাক জুটি:
১. সৈয়দ আব্দুল হাদী- সাবিনা ইয়াসমিন: ‘তুমি ছাড়া আমি একা,পৃথিবী টা ঢেকে থাকা’,দুই জীবন সিনেমার এই রোমান্টিকধর্মী কালজয়ী গান থেকে ‘কথা বলবো না বলেছি শুনবো না শুনেছির মত শ্রোতাপ্রিয় গান নিজেদের কন্ঠে ধারন করেছিলেন কিংবদন্তি এই দুই কন্ঠশিল্পী। এই দুইজনের মায়াভরা কন্ঠেই ‘পৃথিবী তো দুইদিনের ই বাসা’ শুনে শ্রোতারা অশ্রুসজল হয়েছিলেন। সাবিনা ইয়াসমিনের সঙ্গেই গাওয়া ‘এই জীবনে তুমি ওগো এলে’র জন্য জাতীয় পুরস্কার পান সৈয়দ আব্দুল হাদী। অন্যদিকে আলাদা করে ‘কেউ কোনোদিন আমারে তো কথা দিল না’ গানটি দুইজন ই গেয়ে জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন।
২খুরশিদ আলম- রুনা লায়লা: যদি বউ সাজোগো আরো সুন্দর লাগবে কো’,ওয়াদা সিনেমার এই গান সময়ের প্রবাহে আরো বেড়েছে জনপ্রিয়তা কিংবা ‘চুপি চুপি বলো কেউ জেনে যাবে’র মত আরেক যুগান্তকারী হিট গান। দুইটি গানেই জুটিবদ্ধ হয়ে নেপথ্যে গেয়েছিলেন কিংবদন্তি খুরশিদ- রুনা জুটি। কিছুটা চটুল টাইপে তারা বেশ জনপ্রিয় ছিলেন,অনেক গান ই গেয়েছিলেন তাঁরা।
৩এন্ড্রু কিশোর- রুনা লায়লা: ‘চাঁদের সাথে আমি দেব না তোমার তুলনা’,’আশীর্বাদ’ সিনেমার এই যুগান্তকারী গান দিয়ে প্লেব্যাক জগতে শুভসূচনা হয় এই জনপ্রিয় জুটি। আশির দশকে এই জুটির ছিল আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা। ইতিহাস খ্যাত বেদের মেয়ে জোছনার টাইটেল গান থেকে তুমি আমার জীবন আমি তোমার জীবন বা আকাশকে প্রশ্ন করো,তুমি আজ কথা দিয়েছোর মত মুগ্ধ করা গান। আমি একদিন তোমায় না দেখিলে,আজ রাত সারারাত জেগে থাকবো,রুমাল দিলে ঝগড়া হয়,বুকে আছে মন,এখানে দুজনে নির্জনে,ভালোবাসিয়া গেলাম ফাঁসিয়া সহ অসংখ্য জনপ্রিয় গান জুটিবদ্ধ হয়ে গেয়েছেন দুইজনে।
৪এন্ড্রু কিশোর- সাবিনা ইয়াসমিন: ‘কি যাদু করিলা,পিরিতি শিখাইলা’ প্রাণ স্বজনী সিনেমার এই রোমান্টিক গানের তুমুল জনপ্রিয়তা পর প্লেব্যাক জগতে এই জুটির আস্থা বেড়ে যায়। বিশেষ করে মেলোডি ধারার রোমান্টিক গানে এই জুটির যেন জুড়ি নেই। ‘তুমি আমার কত চেনা’গানটিতো আজো সমান জনপ্রিয়। আশি ও নব্বই দশকে এই জুটির অত্যন্ত গ্রহনযোগ্যতা ছিল,দুইজনের সমধুর কন্ঠে বেজে উঠেছে তুমি চাঁদের জোছনা নও,কি দিয়া মন কাড়িলা,পৃথিবীর যত সুখ,স্বপ্নের ঠিকানা,ও সাথীরে মত জনপ্রিয় গান। সাবিনা ইয়াসমিনের সঙ্গে গাওয়া ‘সবাই তো ভালোবাসা চায়’ গান দিয়ে এন্ড্রু কিশোর জাতীয় পুরস্কার ও পেয়েছিলেন।
৫.এন্ড্রু কিশোর- কনকচাঁপা: তোমায় দেখলে মনে হয়,আমার হৃদয় একটা আয়নার মত জনপ্রিয় গান একটা সময় শ্রোতাদের মুখে মুখে ফিরেছিল।কিংবা তোমাকে চাই সিনেমার ‘ভালো আছি ভালো থেকো’ মত যুগান্তকারী গান বাংলা চলচ্চিত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নব্বই পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে জনপ্রিয় প্লেব্যাক জুটির নাম নিলেই প্রথমে এন্ড্রু-কনকের নাম ই আসবে। জুটি বেঁধে একের পর এক গান গেয়েছেন,যার বেশিরভাগ ই পেয়েছে জনপ্রিয়তা। যার আরো প্রমাণ মিলে জীবন ফুরিয়ে যাবে,তুমি হাজার ফুলের মাঝে,কিছু কিছু মানুষের জীবনে,তোমাকে চাই,এক বিন্দু ভালোবাসা দাও,কি যাদু করেছো বলো না,সাগরের মত গভীরের মত অসংখ্য জনপ্রিয় গানে।
৬.খালিদ হাসান মিলু- কনকচাঁপা: ‘আমি যে তোমার প্রেমে পড়েছি,প্রিয় থেকে প্রিয়তম হয়েছি’, মহামিলন সিনেমার এই গান দিয়ে প্লেব্যাকে অভিষেক এই জুটির। যে প্রেম স্বর্গ থেকে এসে কিংবা অনেক সাধনার পরের মত রোমান্টিক গান সমৃদ্ধ অন্যতম সেরা এই প্লেব্যাক জুটি,রোমান্টিক গানে যেন এই দুইজনের জুড়ি নেই। আবার ‘আস্লামালাইকুম বেয়াইন সাব’ এর মত চটুল গানেও এই জুটি সফল। মিলুর অকাল প্রয়ানের কারনে এই জুটির স্থায়িত্ব বেশিদিন হয় নি তবুও এই স্বল্প সময়ে দারুন দারুন গান গেয়ে গেছেন,জায়গা করে নিয়েছেন ইতিহাসের মনিকোঠায়। এমনকি মিলুর সর্বশেষ প্লেব্যাক ‘কোন কাননের ফুল গো তুমি’ তিনি কনকচাঁপার সঙ্গেই গেয়েছেন। শ্রোতাদের কাছে বিশেষ এই জুটির অন্যান্য গানের মধ্যে আমি যে তোমার প্রেমে পড়েছি, সাথী তুমি আমার জীবনে,তোমাকে ভুলতে গিয়ে,তুমি নাই কিছু নাই,লাখো জনম তোমাকে আমি চাই সহ আরো শ্রোতাপ্রিয় গান।
৭.মনির খান-কনকচাঁপা: ‘এই বুকে বইছে যমুনা,নিয়ে অথৈ প্রেমের জল’,প্রেমের তাজমহল সিনেমার অত্যন্ত জনপ্রিয় এই গানের জন্য দুইজন ই ঘরে তুলেছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। মিলু অসুস্থতার জন্য যখন গান গাওয়া ধীরে ধীরে কমিয়ে দিচ্ছিলেন,অন্যদিকে অশ্লীলতা ছেয়ে গেছে চলচ্চিত্রে তখন ই এই আবির্ভাব হয় মনির- কনকচাঁপার জুটির। এরপর সুস্থধারার গানের জগতে বেশ ব্যস্ত সময় কাটিয়েছে এই দুইজন,এদের গাওয়া অন্যান্য গানের মধ্যে ঈশ্বর আল্লাহ বিধাতা জানে,আর যেন ভুল না হয়,তোমার প্রেমে পড়েছি আমি,সুখে আমার বুক ভেসে যায়,সব কিছুরেই শুরু আছে অন্যতম।
৮.আইয়ুব বাচ্চু- কনকচাঁপা: ‘অনন্ত প্রেম তুমি দাও আমাকে’,লুটতরাজ সিনেমার জনপ্রিয় এই গান দিয়ে আইয়ুব বাচ্চুর প্লেব্যাক যাত্রা,সঙ্গে কনকচাঁপার সঙ্গে জুটি বেঁধে গান শুরু করেন। এই গানের রেশ না কাটতেই ‘আকাশ ছুঁয়েছে মাটিকে’ গানের তুমুল জনপ্রিয়তা ব্যস্ততা বেড়ে যায়। এরপর আইয়ুব বাচ্চুর অভিমান করে প্লেব্যাক থেকে সরে আসার আগ পর্যন্ত বেশিরভাগ যৌথ গানেই জুটি বেঁধেছেন কনকচাঁপার সাথে। এই জুটির অন্যান্য গানের মধ্যে কত দু:খ এই জীবনে,তোমার আমার প্রেম এক জনমের নয়,যতদিন যতমাস,যদি থেমে যায় পৃথিবীর কোলাহল অন্যতম।
*হাবিব ওয়াহিদ- ন্যান্সি: ‘তোমাকে ছেড়ে আমি কি নিয়ে থাকবো’ এই গান দিয়ে এই জুটির পথচলা শুরু,ন্যান্সির ও ছিল প্রথম প্লেব্যাক। তবে মূল সিনেমায় এই গানটি রাখা হয় নি,পরে মিউজিক ভিডিও আকারে বের হয়। এরপর হাবিবের সাথেই আকাশ ছোঁয়া ভালোবাসা সিনেমার হাওয়ায় দোলনা দোলে,পৃথিবীর যত সুখ’ এর মাধ্যমে প্লেব্যাকে এই জুটির ঠিকঠাকভাবে যাত্রা শুরু হয়। দুইটি গান ই বেশ জনপ্রিয়তা পায়,’তোমারে দেখিলো’র পর দ্বিধা,আমি তোমার মনের ভিতর ও এতদিন কোথায় ছিলের মত তুমুল সাড়াজাগানোর পর এই জুটির জনপ্রিয়তা আরো বহুগুণ বেড়ে যায়। তখনকার শ্রোতাদের কাছে হয়ে উঠে সবচেয়ে অপেক্ষমান জুটি। তবে আফসোসের বিষয় হাবিব প্লেব্যাকে অনিয়মিত হয়ে গেলে এই জুটিও ভেঙ্গে যায়। সর্বশেষ ‘ধীরে ধীরে’ গানটিও গ্রহনযোগ্যতা পেয়েছিল।
*ইমরান- কনা: এই দুইজনের প্রথম একসঙ্গে প্লেব্যাকের গান ‘রোমিও জুলিয়েট’ এর ছবি এখনো মুক্তি না পেলেও এই জুটি ধীরে ধীরে নিজেদের জনপ্রিয়তা বাড়িয়েই চলেছেন। ছুঁয়ে দিলে মন সিনেমার শূন্য থেকে আসে প্রেমের পর বিশেষ করে ‘দিল দিল’ গান দিয়েই চলচ্চিত্রে হয়ে উঠে সবচেয়ে জনপ্রিয় প্লেব্যাক জুটি,এরপর তো ‘ওহে শ্যাম’ দিয়ে সর্বস্তরের মন জিতে নিয়েছেন,সম্প্রতি ‘তুই কি আমার হবি রে’ও বেশ সাড়া জাগিয়েছে। চলচ্চিত্রে আগের মত জনপ্রিয় গান পাওয়া যায় না,এর মধ্যে এই জুটি কাটাচ্ছে সুবর্ণ সময়।
এছাড়া প্লেব্যাক জুটি হিসেবে আগুন- রুনা লায়লা,আগুন- সাবিনা ইয়াসমিন,খালিদ হাসান মিলু- সাবিনা ইয়াসমিন,এন্ড্রু কিশোর- সামিনা চৌধুরী অন্যতম।
অামাদের সুপারিশ